প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অতুলনীয় চারিত্রিক মাধুর্যের প্রশংসায় মহান আল্লাহ বলেছেন ‘খুলুকুন আজিম’ বা সুমহান চরিত্র-শোভা। তার পুরো জীবন মুমিনদের জন্য ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ’ বা সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত ও মানবাধিকারের সর্বজনীন রূপরেখা। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী।
রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের অর্থই হচ্ছে প্রশংসিত। প্রতিটি যুগে ও সময়কালে মনীষীরা এই মহামানবের প্রশংসা করেছেন। এখনো করছেন এবং করবেন মহাপ্রলয় পর্যন্ত। মুসলিম মনীষীদের পাশাপাশি অগণিত-অসংখ্য অমুসলিম মনীষীরাও তার প্রশংসার স্তুতিগাথা গেয়েছেন। নবীজির অনুপম আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমি জীবনগুলোর মধ্যে সেরা একজনের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম, যিনি আজ লাখো কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিতর্কিতভাবে স্থান নিয়ে আছেন। যেকোনো সময়ের চেয়ে আমি বেশি নিশ্চিত যে- ইসলাম তরবারির মাধ্যমে সেই দিনগুলোতে মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতিতে স্থান করে নেয়নি।
ইসলামের প্রসারের কারণ হিসেবে কাজ করেছে নবীর দৃঢ় সরলতা। অনুসারীদের নিজেকে মূল্যহীন প্রতিভাত করা, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক ভাবনা। বন্ধু ও অনুসারীদের জন্য নিজেকে চরমভাবে উৎসর্গ করা।’ (মহাত্মা গান্ধী, স্টেটম্যান্ট পাবলিশড ইন ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-১৯২৪)
নবীজির পবিত্র জীবনের মূল্যায়নে এ রকম আরও উৎকৃষ্ট উক্তি আরও অসংখ্য মনীষীরা করে গেছেন। তবে এসব উক্তি বা উপমা তেমন কিছুই না সেই উপমার কাছে, যে উপমা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা করেছেন পবিত্র কোরআনে। তিনি মহানবী (সা.)-কে সমগ্র জগতের জন্য ‘রহমত’ বলে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবেই পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)
আরবি ‘রহমত’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো কৃপা, পর-দুঃখমোচন, অনুগ্রহ, অনুকম্পা, বদান্যতা বা দয়া। যে দয়ার কোনো সীমারেখা নেই, অবারিত-সর্ববিস্তৃত। যে দয়া মানুষ-অমানুষ, মুসলিম-অমুসলিম, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, বৃক্ষলতা, পদার্থ, প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জগৎ ও মহাজগৎ নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহেই আপনি তাদের প্রতি কোমলচিত্ত। যদি রুক্ষভাষী ও কঠোর হতেন, তবে তারা আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে যেত।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৪৯)
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা মুমিনদের একথা স্পষ্টই জানিয়ে দেন যে, মুহাম্মদ (সা.) তাদের জন্য কতটা উদার ও দয়াশীল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এসেছে তোমাদের মধ্যকার এমন একজন রাসুল, তোমাদের দুঃখ যার কাছে দুঃসহ। তিনি তোমাদের হিতাকাক্সক্ষী, বিশ্বাসীদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১২৮)
নবীজি নিজে যেমন দয়াশীল ছিলেন, তেমনি তার অনুসারীদেরও দয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, অপরের দুঃখে ব্যথিত হওয়া, অন্যের কষ্ট লাঘবে সর্বাত্মক চেষ্টা করাই যে মানুষের বড় কর্তব্য, সে কথাই তিনি বিশ্বালোকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩১৯)
এখানে উপলব্ধির বিষয় হচ্ছে, নবীজি তার অমূল্য বাণীতে শুধু ‘মুসলিম’ বা ‘মুমিন’ শব্দ উচ্চারণ না করে সর্বজনীনভাবে ‘মানুষ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। কেন না মানুষের জন্যই তো ধর্ম। তায়েফের সেই মর্মান্তিক ঘটনা কে না জানে? নবীজি সেখানে আল্লাহর কথা বলতে গিয়ে পাথরের আঘাতে জর্জরিত হলেন, রক্তাক্ত হলেন। আল্লাহর আদেশে ফেরেশতা এসে বললেন, ‘আদেশ করুন, দুই পাহাড় একত্র করে এদের পিষে ফেলি।’ নবী বললেন, ‘না, এদের পরপ্রজন্ম হয়তো ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৩১)
প্রিয়নবী (সা.) অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিও ছিলেন মহানুভব। তাদের অধিকারপ্রাপ্তির ব্যাপারে তিনি মুসলমানদের অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া বা প্রতিরক্ষা কর) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষাবলম্বন করব।’ (আল-বায়হাকি, মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদিস : ৫৭৫০)
অন্য এক হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশ দিয়ে একবার এক লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি তা দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল এ তো ইহুদির লাশ। রাসুল (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আলাইসাত নাফ্সান?
অর্থাৎ সে কি মানুষ নয়? (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩১২)
সুবহানাল্লাহ! মানবতার কী উত্তম দৃষ্টান্ত। নবীজির দয়া শুধু মানবজাতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সিক্ত করেছে বাকহীন পশু-পাখির জগৎকেও। তাদের জন্যেও নবীজির মমতা ছিল মানুষের মতোই। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা এক সফরে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম।
এক সময় একটু প্রয়োজনে দূরে গেলাম। দেখলাম একটি লাল পাখি এবং সঙ্গে দুটি বাচ্চা। আমরা বাচ্চা দুটি ধরে নিয়ে এলাম। কিন্তু সঙ্গে মা-পাখিটিও চলে এলো। বাচ্চা দুটির কাছে আসার জন্যে পাখিটি মাটির কাছে অবিরাম উড়ছিল। তখন রাসুল (সা.) এসে পড়লেন। তিনি এটি দেখে বললেন, কে এ বাচ্চা ধরে এনে এদের মাকে কষ্ট দিচ্ছে? যাও, বাচ্চা দুটিকে মায়ের কাছে রেখে এসো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৬/২)