সময়ের সংবাদ: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের কয়েক ডজন কর্মকর্তা বছরের পর বছর রাজধানী ঢাকায় চাকরি করছেন। শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ঘুরেফিরে তাদেরই পদায়ন হচ্ছে। তাদের কারণে প্রকৃত মেধাবীরা রাজধানীতে পোস্টিং পান না। দীর্ঘদিন ঢাকায় চাকরির সুবাদে তারা গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সিন্ডিকেট। আর তাদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা আর দুর্নীতির কারণে সরকার বারবার বিব্রত হচ্ছে। সর্বশেষ এই সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্যের কারণেই চলতি বছর প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই মারাত্মক ভুল ও ত্রুটিপূর্ণভাবে ছাপা হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, এবার বইয়ের ভুলের দায়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ সরকার ও ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খানকে ওএসডি ও আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার সুজাউল আবেদিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ না হওয়ার পরও প্রীতিশ সরকার ও লানা হুমায়রা সেখানে কাজ করতেন। আট বছর ধরে প্রীতিশ ঢাকায় চাকরি করছেন। তিনি শুধু এবারই নয়, ২০১০ সালেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি কলেজ শাখার উপ-পরিচালক থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ দলীয় একজন এমপির আত্মীয়ের কাছ থেকে এমপিওভুক্তির জন্য পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন। এ ব্যাপারে ওই এমপি প্রীতিশের বিরুদ্ধে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন। তাৎক্ষণিক ওএসডি করা হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি আজও। ঢাকার বাইরের একটি কলেজে বদলি করা হলে কয়েক মাসের মধ্যে আবার চলে আসেন তিনি এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তৎকালীন প্রধান সম্পাদক ড. আবদুল মান্নান অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলে ২০১৩ সালে ওই পদে আসীন হন প্রীতিশ। লানা হুমায়রা আওয়ামী লীগ দলীয় একজন নেতার মেয়ে ও ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী। ঢাকায় থাকা জরুরি, তাই তাকে ঢাকায় রাখার জন্যই পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে পদায়ন করা হয়েছে। অথচ এটি একটি বিশেষজ্ঞের পদ। একইভাবে এনসিটিবির সচিব ইমরুল হাসান এনসিটিবি ও মাউশি মিলে ৭ বছর, প্রধান হিসাব রক্ষক মনিরুল ইসলাম ১২ বছর (এর আগে ২০০৫ সাল থেকে মাউশি ডিজির পিএ পদে), উপ-সচিব (কমন) সৈয়দ মইনুল হোসেন ৬ বছর, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ মুনাবি্বর হোসেন ও মোখলেছুর রহমানও বছরের পর বছর ধরে ঢাকায় চাকরি করছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাসুদ করিম এনসিটিবি ও বোর্ড মিলিয়ে ৭ বছর, বিদ্যালয় পরিদর্শক এটিএম মইনুল ২০০৯ থেকে মাউশি ও ২০১৪ থেকে বোর্ডে, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আবুল বাসার মাউশি, ঢাকা ও মাদ্রাসা বোর্ড মিলিয়ে আট বছর, মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার উপ-পরিচালক রাশেদুল হাসান ৫ বছর, উপ-পরিচালক (বেসরকারি কলেজ) মেজবাহ উদ্দিন ৮ বছর, উপ-পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) ফারহানা হক নীলা ৮ বছর (তার আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ৪ বছর ও ডিআইএতে ৪ বছর), পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াস হোসেন ৪ বছর চাকরি করছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া ঘুষ-বাণিজ্যের দায়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নাম কামিয়েছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. আশফাকুস সালেহীন। তার বিরুদ্ধে রাজবাড়ী ও নরসিংদীর দু’জন সংসদ সদস্য ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ করেছেন। সালেহীনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের বিবদমান দুটি পক্ষের একটি গ্রুপের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে জানানো হলেও এখনও সালেহীন বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। সালেহীন এর আগে মাউশির উপ-পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ছিলেন। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবির করলেও বর্তমান সরকারের আমলে রাজধানীতে দাপটের সঙ্গে চাকরি করছেন ৬ বছর ধরে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈও বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। তিনি এপিএস থাকার সময় তার কথামতোই বদলি হতো। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে প্রায় দুই বছর আগে তাকে এপিএস পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শকের পদে পদায়ন করা হয়। চলতি বছরে তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির কেন্দ্রীয় নেতৃস্থানীয় পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সেখান থেকে এখনও শিক্ষা প্রশাসনের বদলি ও পদায়নের নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা যায়। আর তাকে এই কাজে সহায়তা করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। জানা যায়, একই স্থানে দীর্ঘদিন ধরে শিকড় গেড়ে বসা কর্মকর্তারা নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি শিক্ষা বোর্ডগুলোতে প্রচুর আয়ের উৎস থাকায় সেখান থেকে কর্মকর্তারা কোনোভাবেই বদলি হতে চান না। কর্মচারী সমিতির অভিযোগ থেকে জানা যায়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবির চৌধুরী ২০০৯ সালে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে পদায়ন পান। এরপর সহযোগী অধ্যাপক থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে অধ্যাপক পদমর্যাদার সচিব পদে তাকে পদায়ন করা হয়। এরপর থেকে তিনি ওই পদে রয়েছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ) মাসুদা বেগমও রয়েছেন ২০০৯ সাল থেকে। নানা অভিযোগ থাকার পরও তিনি সাত বছর ধরে একই পদে রয়েছেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি পদও দখল করে রেখেছেন। ২০০৩ সাল থেকে ঢাকা বোর্ডে উপ-পরিচালক পদে কর্মরত রয়েছেন আবুল ফজল এলাহী। ২০০২ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে পদায়ন পান মো. মুজিবর রহমান। ২০১৪ সালে বদলি হন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম)। এরপর আবার ২০১৫ সাল থেকে রয়েছেন মাদ্রাসা বোর্ডের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে। এ ছাড়া অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডেও একাধিক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত রয়েছেন। জানা যায়, মাউশি অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের উপ-পরিচালক এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার ২০০৯ সালে ঢাকা বোর্ডে উপসচিব হিসেবে পদায়ন পান। এরপর ২০১৩ সালে মাউশি অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক ও বর্তমানে উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল আলম প্রামাণিকের একান্ত সচিব ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে নায়েমে কর্মরত রয়েছেন উপ-পরিচালক কালাচাঁদ শীল ও রিয়াদ চৌধুরী। মাউশি অধিদপ্তরের আইন কর্মকর্তা আবুল কাশেম ২০০৪ সাল থেকে ও সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) মো. সাইফুল ইসলাম রয়েছেন ২০০৫ সাল থেকে। ৪ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত ঘুরেফিরে যেসব কর্মকর্তা ঢাকায় চাকরি করছেন, তাদের মধ্যে আরও রয়েছেন- নায়েমের প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ মামুনুল হক (১৪ বছর), আবদুর রাজ্জাক মিয়া (১৩ বছর), খান মুহম্মদ মইনুল হক (১৩ বছর), একইভাবে রয়েছেন জহরুল আলম, এসএম রবিউল ইসলাম, ড. মো. খাদেমুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ আলী, শায়েলা পারভীন, ড. রিয়াদ চৌধুরী, সায়েমা রহমান, শিখা চক্রবর্তী, আসমা আক্তার খাতুন, মোয়াজ্জেম হোসেন সেলিম, স্বপন কুমার নাথ, সাবিহা ইয়াসমিন ও সাহিদা সুলতানা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আফছারুল আমীন সমকালকে বলেন, ‘বিসিএস শিক্ষা ক্যাডাররা মূলত কলেজ শিক্ষক। তাদের প্রশাসনে কাজ করার চেয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানেই বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকটও রয়েছে। এরপরও যারা বছরের পর বছর ডেপুটেশনে শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা বোর্ডগুলোতে রয়েছেন, তাদের সরকারি নিয়মানুযায়ী তিন বছর পর বদলি করা উচিত। কারণ ক্লাসরুমে না গেলে তো প্রশাসনিক নীতিনির্ধারণ করা যায় না। –