মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অভিভাবকসহ দায়িত্বশীলরা বলছেন, রোমাঞ্চকর কোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণ তারুণ্যের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তাই তাদের কেউ কেউ রেসের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ‘খেলা’ থেকে আনন্দ পেতে চায়। তাদের বোঝাতে হবে, আনন্দের বিকল্প অনেক উৎস আছে। তা ছাড়া রেস তার নিজের জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে। ঢাকার রাস্তায় এ ধরনের অনুমোদনহীন রেস ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধে পুলিশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা দাবি করেছে।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নগরীর ৬শ’ পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। বেশিরভাগ পয়েন্টে রাত ১১টা ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্টে রাত ২টা পর্যন্ত ট্রাফিক থাকে। গভীর রাতে ট্রাফিক না থাকার সুযোগে কেউ কেউ বেপরোয়া গাড়ি চালায়। কিছু সড়কে গাড়ি বা মোটরসাইকেল রেস হয় বলেও জানা গেছে। সেগুলো প্রধান সড়কের বদলে ভেতরের দিকের সড়কগুলোয় বেশি হয়। গুলশান-বনানীতে এমন চিত্র দেখা যায়।
রাজপথে রেস :ট্রাফিক পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ঢাকায় গাড়ি ও মোটরসাইকেল রেসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু গ্রুপ। তাদের অনেকেই বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। গভীর রাতে তারা ফাঁকা রাস্তায় রেসে নামে। গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমণ্ডি, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় রেস হয়। এ ছাড়া বাড্ডার ৩শ’ ফুট রাস্তা, আফতাবনগর ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ফাঁকা রাস্তায় প্রায়ই এমন রেস দেখা যায়। তবে এসব এলাকায় মূলত নতুন বা প্রশিক্ষণার্থীরা বেশি যায়। একটু দক্ষ হলে তারা মূল সড়কে নেমে পড়ে। বিকট শব্দে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে তারা মাঝেমধ্যেই অন্য যানবাহন বা পথচারীদের ধাক্কা দেয়। প্রচণ্ড গতির কারণে বেশিরভাগ ঘটনায় আহত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এমন রেসের নেশা রয়েছে আসিফ রহমান অন্তুর। তিনি স্টান্টনির্ভর
গ্রুপ ‘বিডি বাইক স্টান্টস’-এর সদস্য। তিনি বলেন, অনেকেই রেস ও স্টান্টকে গুলিয়ে ফেলেন। দুটি কিন্তু এক ব্যাপার নয়। স্টান্ট হলো, ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে নানা রকম কসরৎ দেখানো। এটি ক্রিকেট বা অন্যান্য জনপ্রিয় খেলার মতোই একটি খেলা। রেসের গতিবেগ ৭০ থেকে শত মাইল।
আসিফ রহমান বলেন, সাধারণত অল্প বয়সীরা মজা করার জন্য এটা করে; কিন্তু তারা ঝুঁকির বিষয়টি ভুলে যায়।
রেস ও স্টান্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ফেসবুকে সক্রিয় এমন ২১ জনের ইনবক্সে সমকালের পক্ষ থেকে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাড়া দেন। মজার ব্যাপার, রেস বিষয়ে তারা কিছুই বলতে রাজি হননি। তাদের মধ্যে জুবায়ের আল মাহমুদ নামে একজন সমকালকে বলেন, তারা বন্ধুরা মিলে রেস করেন। এ বিষয়ে তিনি পরে কথা বলতে চান। পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি আর কথা বলতে চাননি। সেলিম রেজা অপু নামে আরেক তরুণ বলেন, মিরপুর-২ নম্বর সেকশনে ‘বাইক স্টান্ট’ হয়। এর বেশি কিছু তিনি বলতে পারবেন না। ফেসবুকে ‘বাইক রেসার’ ছদ্মনামে থাকা এক তরুণ দাবি করেন, তিনি এখন আর রেসের সঙ্গে জড়িত নন। তিনি ওই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। মিয়াদুর রহমান সোহাগ দাবি করেন, মোটরসাইকেল চালালেও তিনি রেস করেন না। হাজী সৈয়দ মামুন বলেন, সবাইকে আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এসব রেস বা স্টান্ট করা হয়।
স্টান্ট ও রেসের সঙ্গে জড়িতদের কিছু গ্রুপ আছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে_ বিডি ঘোস্ট রাইডার্স, ফেরোশাস ফ্লাশ, হান্ট রাইডার্স, অল অ্যাবাউট রোড রাইডার্স, এক্সাইল রাইডার্স, বিডি রাইডার্স ক্লাব, ব্লাইন্ডেড হুইলম্যানস অব রংপুর, নারায়ণগঞ্জ রাইডার্স, নোয়াখালী রাইডার্স, রাজশাহী রাইডার্স, বগুড়া স্ট্রিট রাইডার্স, সৈয়দপুর ক্রেজি রাইডার্স ও পটুয়াখালী রাইডার্স। অবশ্য এ গ্রুপগুলোর দাবি, তারা মূলত স্টান্ট করে থাকে।
বিডি ঘোস্ট রাইডার্স সম্পর্কে ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি মোটরসাইকেল চালকদের একটি জনপ্রিয় দল, যারা ভয় কাকে বলে জানে না। উন্মত্ত ও দুঃসাহসিক চালনাই তাদের বৈশিষ্ট্য।
ভিডিওচিত্রে রেস ও স্টান্ট :ঢাকায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর দৃশ্য ধারণ করে অনেক সময় ফেসবুক গ্রুপ বা ইউটিউবে আপলোড করা হয়। গত বছরের ২০ মে ইউটিউবে মেহেদী রহমান শাওন নামের অ্যাকাউন্ট থেকে এমন একটি ভিডিও আপলোড করা হয়। তাতে দেখা যায়, বিমানবন্দর সড়কে দিনের বেলায় বিপজ্জনক গতিতে গাড়ি চালিয়ে একের পর এক যানকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অতিক্রম করছে একজন। ‘ঢাকায় গাড়ির রেস’ শীর্ষক চার মিনিট ২৬ সেকেন্ডের ভিডিওটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ঢাকায় এত গতি এর আগে কেউ দেখেনি।
‘বিডি ঘোস্ট রাইডার্স বাইক স্টান্ট’ নামের ইউটিউব অ্যাকাউন্ট থেকে আপলোড করা একটি ভিডিওতে কয়েক তরুণকে দিনে ও রাতে ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে নানা রকম কসরৎ করতে দেখা যায়। ‘বিডি বাইক স্টান্ট’ নামের একটি ফেসবুক পৃষ্ঠায় আপলোড করা ভিডিওতে দেখা যায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে কসরৎ দেখানোর এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক তরুণ গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
সাধারণ গাড়িকে স্পোর্টস কারে রূপান্তর :ঢাকার কাকরাইল ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ‘ম্যাক্স পাওয়ার’ নামে দুটি গাড়ির শোরুমের মালিক এমএ হাসিব হাসনু বলেন, রেসের জন্য বিশ্বব্যাপী ‘স্পোর্টস কার’ ব্যবহৃত হয়। এসব গাড়ি খুব দামি। এগুলো সাধারণত আকারে ছোট, দুই আসনবিশিষ্ট, ক্ষিপ্র্র গতি ও দ্রুত চালানোর সুবিধাসম্পন্ন। থাকে বাড়তি কিছু নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য। স্পোর্টস কারের ইঞ্জিন অন্তত দুই হাজার সিসি ও ৬শ’ অশ্বশক্তির (হর্সপাওয়ার) হয়। তবে ঢাকায় সাধারণ গাড়ি দিয়েও রেস হয়। এসব গাড়িতে কিছু সরঞ্জাম সংযোজন-বিয়োজন করে স্পোর্টস কারের আদল তৈরি করা হয়। ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়ানো ও গাড়ির বডি নিচুও করা হয়। এই গাড়ি ব্যবসায়ী আরও বলেন, দেশে নিটল-টাটার সৌজন্যে বছরে একবার কার রেস হয় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। এ ছাড়া রাতের রাস্তায় কিছু রেস হয়, যা অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
ঝরছে তাজা প্রাণ :রেসের সময় দুর্ঘটনায় হতাহতের কোনো পরিসংখ্যান পুলিশের কাছে আলাদাভাবে নেই। তবে তাদের মতে, গত এক বছরে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৮৫ জন নিহত ও ৩৮৯ জন আহত হয়েছে। এর একটি অংশ ঘটেছে রাতে ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য।
ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবু ইউছুফ সমকালকে বলেন, ক্রসিংয়ের সুযোগ আছে এমন রাস্তায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। রাতের দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত প্রাণঘাতী হয়।
‘তরুণদের সচেতন করে তুলতে হবে’ :মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, তরুণরা আনন্দ পেতে ও নিজেকে নায়কোচিত দেখাতে রেস বা স্টান্টের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কিছু করে। এমন একজনকে দেখে অন্যরাও তার মতো হতে চায়। কিন্তু তারা শুধু আনন্দ দেখে; পরিণতিটা দেখে না। বেপরোয়া গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে কত মানুষের মৃত্যু হয়, কতজন পঙ্গু হয়_ এসব ভালোভাবে জানলে তারা এ কাজ করত না। তাদের সচেতন করে তোলার প্রথম দায়িত্ব মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের। এতে কাজ না হলে তারা মনোবিদদের সহায়তা নিতে পারেন।
নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, রেসের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে না জড়ানোর জন্য নটর ডেম কলেজে শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়।
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের মিডিয়া অফিসার সৈয়দ সাইফুল ইসলাম শোভন বলেন, ধানমণ্ডি লেকের পাশে ও সাত মসজিদ রোডে প্রায় রাতেই কিছু তরুণ, এমনকি তরুণীকেও রেস করতে দেখা যায়। তাদের গাড়ির প্রচণ্ড গতি ও ভীতিকর শব্দে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এতে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
পুলিশের উদ্যোগ :ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান সমকালকে বলেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বা রেসের মতো ঘটনা ঠেকাতে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ রয়েছে। রাতের রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্টে বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধক দিয়ে রাখা হয়। রাস্তার ওই অংশ এঁকেবেঁকে পার হতে হয় বলে গতি না কমিয়ে উপায় থাকে না। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে বসানো তল্লাশি চৌকি ও পুলিশের টহল দল অতিরিক্ত গতির গাড়ি থামিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়।