সময়ের সংবাদ: শনিবার, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম পূর্ণ কর্মদিবসে, তথ্যমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনে সিআইএর সদর দপ্তরে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাতে মার্কিন তথ্যমাধ্যমকে ‘বিশ্বে সবচেয়ে অসৎ’ বলে অভিহিত করেন তিনি। তাঁর অভিযোগের কারণ, তিনি মনে করেন তথ্যমাধ্যম তাঁর অভিষেকে উপস্থিত দর্শকসংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখিয়েছে।
একই দিন বিকেলে হোয়াইট হাউসে তড়িঘড়ি করে ডাকা এক ব্রিফিংয়ে ট্রাম্পের মুখপাত্র শন স্পাইসার সাংবাদিকদের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলেন, মিথ্যাচারের মাধ্যমে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করছে। তাদের মিথ্যাচার বন্ধ করতে হোয়াইট হাউস তথ্যমাধ্যমকে নজরদারির মধ্যে রাখবে।
তথ্যমাধ্যমের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন যখন মিথ্যাচারের এ অভিযোগ আনে, ঠিক সেই সময় হোয়াইট হাউসের বাইরে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভাবিত বিজয়ের প্রতিবাদে এক অভূতপূর্ব ‘নারী পদযাত্রায়’ অংশ নিচ্ছিল। শুধু ওয়াশিংটন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহরে আরও ১০ লাখের মতো মানুষ এ পদযাত্রায় অংশ নেয়। বিশ্বের বিভিন্ন শহরেও অসংখ্য মানুষ মার্কিন নাগরিকদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এবং ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নীতিমালার প্রতিবাদে পথযাত্রায় শামিল হয়।
পদযাত্রা বিষয়ে এদিন ট্রাম্প নিজে অথবা তাঁর মুখপাত্রের মাধ্যমে কোনো মন্তব্য করেননি। টুইটও করেননি। গতকাল রোববার এক টুইট বার্তায় তিনি জানান, নারী পদযাত্রার ছবি তিনি দেখেছেন। এসব মানুষ (তাঁর প্রতিপক্ষকে) কেন ভোট দেয়নি, তিনি জানতে চান।
মার্কিন মিডিয়ার প্রতি ট্রাম্পের বিরুদ্ধ মনোভাব সুপরিচিত। নির্বাচনী প্রচারের সময় সাংবাদিকদের দিকে আঙুল তুলে তিনি প্রায়ই বলতেন, এরা হচ্ছে সবচেয়ে অসৎ মানুষ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পরও তিনি মিডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখায় তা অনেককে বিস্মিত করেছে। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডেভিড ব্রিংকলি ট্রাম্পের এ আচরণকে ‘সাত বছরের বালকের কাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন।
অনেকেই ভেবেছিলেন, শনিবার সিআইএর সদর দপ্তরে তাঁর প্রথম আগমন উপলক্ষে ট্রাম্প এই গোয়েন্দা দপ্তরের সঙ্গে তাঁর পুরোনো বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে চেষ্টা করবেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় সিআইএ এবং এফবিআই এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়, মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল যাতে ট্রাম্পের অনুকূলে যায়, সে উদ্দেশ্যে রাশিয়া ডেমোক্রেটিক পার্টির ডেটাবেইসে সাইবার হামলা চালায়। ট্রাম্প সে অভিযোগ মিথ্যা বলে অভিহিত করেন এবং মার্কিন গোয়েন্দাদের আচরণকে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে তুলনা করেন।
সিআইএ সদর দপ্তরে কর্মকর্তাদের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সময় ট্রাম্প পুরোনো বিতর্কে ফিরে যাননি বা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য নিরসনের কোনো চেষ্টা করেননি। তার বদলে সে বক্তব্যের অধিকাংশই ব্যয় করেন তাঁর সমালোচকদের প্রতি পাল্টা আক্রমণে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, তাঁর আক্রমণের শিকারের মধ্যে ছিলেন সেসব ব্যক্তি, যাঁরা তাঁকে যথেষ্ট চৌকস ও বুদ্ধিমান ভাবেন না। সিনেটের সদস্যরা যাঁরা তাঁর প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগ চূড়ান্ত করায় বিলম্ব করছেন এবং সাংবাদিকেরা, যাঁরা তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকসংখ্যা নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন। ট্রাম্প দাবি করেন, এসব মিথ্যাবাদী সাংবাদিককে তিনি হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন।
সিআইএর যেসব গোয়েন্দা তাঁদের দায়িত্ব পালনকালে নিহত হয়েছেন, তাঁদের নামাঙ্কিত একটি দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প এ বক্তব্য দেন। গোয়েন্দা দপ্তরের সদস্যদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারের সময় যেভাবে ভাষণ দিতেন, তার অনুকরণে বক্তব্য দেওয়ায় অনেক সিআইএ কর্মী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাবেক সিআইএ প্রধান জন ব্রেনান তাঁর মুখপাত্রের মাধ্যমে এক বিবৃতিতে জানান, ট্রাম্পের এই ব্যবহারে তিনি একই সঙ্গে দুঃখিত ও আহত।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর কাছে নাম না প্রকাশের শর্তে সিআইএর একজন কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্প এই সংস্থার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টার বদলে পুরো সময়টা যেভাবে নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে কত দর্শক হয়েছে, তার হিসাব দিয়ে বিবাদে কাটালেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।
বিকেলে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে হোয়াইট হাউসের নতুন মুখপাত্র শন স্পাইসার দাবি করেন, ট্রাম্পের অভিষেকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক দর্শকের সমাগম হয়েছিল। টিভি ও পত্রপত্রিকায় ওবামার ২০০৯ সালের অভিষেকের সঙ্গে তুলনা করে পাশাপাশি যে ছবি ছাপা হয়েছে, স্পাইসারের দাবি, সেটি ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হয়েছে। একপর্যায়ে তিনি দাবি করেন, কারও পক্ষে দর্শকসংখ্যা বলা সম্ভব নয়, কিন্তু পরমুহূর্তেই দাবি করেন এই অভিষেকে সাড়ে সাত লাখ দর্শকের উপস্থিতি ছিল। ওবামার অভিষেকের তুলনায় ট্রাম্পের অভিষেকে অধিক দর্শক ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে তিনি গণপরিবহন দপ্তরের প্রদত্ত হিসাব দিয়ে বলেন, ওবামার ২০১৩ সালের অভিষেকের সময় যেখানে ৩ লাখ ১৭ হাজার মানুষ ওয়াশিংটনের মেট্রো বা পাতালরেল ব্যবহার করে, সেখানে ট্রাম্পের অভিষেকের সময় ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ এই রেল ব্যবহার করে।
মেট্রো কর্তৃপক্ষ তথ্যমাধ্যমের কাছে যে পরিসংখ্যান প্রদান করে, তাতে দেখা যায় স্পাইসার উভয় সংখ্যাই ভুল বলেছেন। ট্রাম্পের অভিষেকের দিন মোট ৫ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মেট্রো ব্যবহার করে। ২০১৩ সালে ওবামার অভিষেকের দিন মেট্রো ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৮২ হাজার। ২০০৯ সালে ওবামার প্রথম অভিষেকে মেট্রো ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ। ওয়াশিংটনের পার্ক সার্ভিসের হিসাব অনুসারে, ২০০৯ সালে ওবামার অভিষেকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ।
নতুন মার্কিন প্রশাসন শুরুতেই অন্য সব বাদ দিয়ে কত লোক অভিষেকে এসেছে তা নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় হতবাক হয়ে পড়েছে অনেকে। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, অভিষেকে দর্শকসংখ্যা নিয়ে ট্রাম্পের দাবি মিথ্যা। রাজনৈতিক পত্রিকা পলিটিকো লিখেছে, ট্রাম্পের মুখপাত্র মাত্র পাঁচ মিনিটের এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে চারটি মিথ্যা কথা বলেন। ওবামার সাবেক উপদেষ্টা ডেভিড এক্সেলরড বলেছেন, ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউস মার্কিন জনগণের সঙ্গে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। দেশের প্রেসিডেন্ট এমন সামান্য বিষয় নিয়ে মিথ্যাচার করবেন, তা ভাবা যায় না।