সিরাজগঞ্জের তাড়শে রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাশেম আজাদের বিরুদ্ধে মরা মানুষের টাকাসহ ৪ জন শিক্ষকের বেতন ভাতার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সুপার কে বি এম আব্দুল মান্নান। সি আর মামলা নং ৫১/১৯ (তাড়াশ)। এরপর তারা যোগসাজশ করেন। পরে একই অপরাধে সাবেক ভারপ্রাপ্ত ঐ দুই জন সুপারের বিরুদ্ধে মামলা করেন রোকনপুর মাদ্রাসার বর্তমান সুপার মো. দলিলুর রহমান মুক্তা। সি আর মামলা নং ৪৭/২০২০ (তাড়াশ)। তারপর থেকে অভিযুক্তরা সুপার মো. দলিলুর রহমান মুক্তার সাথে শত্রুতা শুরু করেন। বিশেষ করে তাদের কারণে মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, মো. আবুল কাসেম আজাদ ও কে বি এম আব্দুল মান্নান রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার থাকাকালীন নানা রকম অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন। প্রাক্তন সুপার আব্দুস ছাত্তার ২২/০৮/১৫ তারিখে মারা যাওয়ার পর তার স্বাক্ষর জাল করে বেতন ভাতার টাকা সোনালী ব্যাংক তাড়াশ শাখার ৩৪০১০৮৬৫ নং হিসাবে জমা করে আত্মসাৎ করেন।
অনুরূপভাবে রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার দাখিল বিভাগের জুনিয়র শিক্ষক মকসেদ আলী ১১/১০/১৫ তারিখে অবসরে যাওয়ার পর ও এফতেদায়ী শাখার জুনিয়র মৌলভী এস এম ইব্রাহীম হোসেন ০৪/০৩/১৬ তারিখে অবসরে যাওয়ার পর তাদের বেতন ভাতা আত্মসাত করেন। একই সাথে ঐ মাদ্রাসার দাখিল শাখার মাসুমা খাতুন নামে এক জন সহকারী শিক্ষক অন্য মাদ্রাসায় যোগদান করার পর তার বেতন ভাতার টাকা আত্মসাত করেন।
সরকারি বিধি মোতাবেক মাদ্রাসার বেতন ভাতার বিল প্রস্তুত করার সময় মৃত, অবসরপ্রাপ্ত ও অন্য প্রতিষ্ঠানে যোদানকৃত শিক্ষকের নাম বাদ দিয়ে মাসিক বিল করে ব্যাংকে জমা দিতে হয়। কিন্তু অভিযুক্ত রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাসেম আজাদ ও কে বি এম আব্দুল মান্নান মাদ্রাসার সব কর্মচারী, শিক্ষক ও তৎকালীন সভাপতি মো. জাহিদুল ইসলামের স্বাক্ষর জাল করে ২ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাত করেন।
সি আর ৫১/১৯ (তাড়াশ) নং মামলাটির তদন্ত করেন সিআইডি। সেই তদন্ত প্রতিবেদনের মতামত হুবহু তুলে ধরা হলো, ‘মামলাটি সার্বিক তদন্তে প্রাপ্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণে, ব্যাংক ষ্টেটম্যান্ট, এমপিও’র কপি, মাসিক বেতন ভাতার কপি, এড়িয়া বিলের কপি ও বোনাসের কপি পর্যালোচনায় এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় আসামী মো. আবুল কাশেম আজাদ (৫০), পিতা: গহের উদ্দিন শেখ, সাংঃ রোকনপুর, থানা: তাড়াশ, জেলা: সিরাজগঞ্জ পেনাল কোডের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪৬৭/৪৭১/৪০৬ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হইয়াছে। ’
সিআইডি, সিরাজগঞ্জের উপ-পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) মো. ছায়েদুর রহমান ১০/০৩/১৯ তারিখে প্রতিবেদনটি বিজ্ঞ সিনিঃ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালত-০৫, তাড়াশ অঞ্চল, সিরাজগঞ্জ বরাবর দাখিল করেন।
সি আর ৪৭/২০২০ নং (তাড়াশ) মামলাটির তদন্ত করেন মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ। ১৭/০৭/২০১৯ তারিখে উভয় পক্ষের শুনানী শেষে রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাসেম আজাদ ও কে বি এম আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। সেই মতামত হুবহু তুলে ধরা হলো। ‘মামলাটি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, শিক্ষক মো. আবুল কাশেম আজাদ এবং কে বি এম আব্দুল মান্নান ২ জন যোগসাজশে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করেছেন। ২,৩১,১৮৯.০০ (দুই লক্ষ একত্রিশ হাজার একশত উননব্বই) টাকা এই অতিরিক্ত অর্থের মধ্যে হতে ২,১১,০২৯.০০ (দুই লক্ষ এগাড় হাজার উনত্রিশ) টাকা ১ নং আসামী মো. আবুল কাশেম আজাদ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেতন ভাতার মাদ্রাসার সরকারি হিসাব আম্বারে ৩৩০১০৫৩৬ এর অনুক‚লে জমা প্রদান করেছেন। এ প্রতিবেদনটি দাখিল করেন, তাড়াশ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফকির জাকির হোসেন।
রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ২০১৭ সালের অডিট রিপোর্টের ‘দ’, ‘ধ’ ও ‘ন’ অনুচ্ছেদের চিত্র হুবহু তুলে ধরা হল। “ ‘দ’ অনুচ্ছেদে প্রাক্তন ক্বারী (বর্তমানে সহঃ মৌলভী) কে বি এম আব্দুল মান্নান কর্তৃক গৃহীত ৯৩,৮৩০/- টাকা, ‘ধ’ অনুচ্ছেদে ২ জন অতিরিক্ত জুনিয়র শিক্ষক কর্তৃক গৃহীত ১,৯৭,৭৩৪/২৫ টাকা এবং ‘ন’ অনুচ্ছেদে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত গৃহীত জুনিয়র শিক্ষক জনাব মুহঃ মকসেদ কর্তৃক গৃহীত ২৬,৭৭৫/- টাকা সরকারি কোষাগাড়ে ফেরতের সুপারিশ ছিল। সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্পর্কিত রেকর্ড মাদ্রাসার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপারিনটেনডেন্ট প্রদর্শন করতে পারেননি। অবাস্তবায়িত সুপারিশসমুহ বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা পরিদর্শক মো. ছালেহ্ উদ্দিন শাহ স্বাক্ষরিত ০২/০৩/২০২২ তারিখে এ প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়।
প্রসঙ্গত: এই অডিট পরিদর্শন ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের। তখন রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার ছিলেন কে বি এম আব্দুল মান্নান।
এদিকে রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার দাখিল শাখার তোজামেল হোসেন নামে আরেকজন প্রাক্তন জুনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতি করে চাকরির অভিযোগ ওঠে। সরকারি বিধি মোতাবেক একজন সহকারী শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে এইচ এস সি পাশ অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত (পিটিআই) হতে হয়।
জানা গেছে, অভিযুক্ত রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার দাখিল শাখার তোজামেল হোসেন নামে ঐ শিক্ষক সিরাজগঞ্জ ভাসানি কলেজ হতে পর পর দুই বার এইচ এস সি (বহিরাগত) হিসাবে পরিক্ষায় অংশগ্রহন করে কৃতকার্য হতে পারেননি। এ কারণে তৎকালীন তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বালিজুর রহমান ১৯৯৪ সালে তার বেতন ভাতা বন্ধ করে দেন।
রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. দলিলুর রহমান মুক্তা বলেন, মামলাতে শুধু ২০১৬ সালের ৯ মাসের টাকা আত্মসাতের তথ্য রয়েছে সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাশেম আজাদ ও কে বি এম আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে। বস্তুত তারা অনেক বেশি টাকা আত্মসাৎ করে রেখেছেন।
তিনি আরো বলেন, আমি মাদ্রাসার পক্ষে বাদি হয়ে সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাসেম আজাদ ও কে বি এম আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করায় এবং প্রাক্তন জুনিয়র শিক্ষক তোজাম্মেল হোসেনকে বিধি মোতাবেক শোকচ নোটিশ দেওয়ার ফলে তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরই মধ্যে আমাকে প্রতিষ্ঠানে আসতে বাধা দিয়েছেন তারা। সর্বপরি মাদ্রাসায় গেলে আমাকে প্রাণে মারার হুমকি দেন। এ নিয়ে আমি তাড়াশ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছি ১৯/০৮/১৯ তারিখে। জিডি নং ১২১১।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী বলেন, আমাদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাশেম আজাদ ও প্রাক্তন জুনিয়র শিক্ষক তোজাম্মেল হোসেন সম্পর্কে দুলাভাই ও শ্যালক। তাদের বাড়ি রোকনপুর গ্রামে। স্থানীয় প্রভাবে তারা মাদ্রাসা বিরোধী নানা কান্ড ঘটিয়ে চলেছেন। বিশেষ করে সর্বদাই আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন। মাঝে মধ্যে অন্যান্য মানুষজনের সাথে দল বেধে মাদ্রাসায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। এতে আমাদের পড়ালেখায় খুব ব্যাঘাত ঘটে।
শিক্ষার্থীরা আরো বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় আমাদের মাদ্রাসা। আশপাশে তেমন কোন ভালো ধর্মীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাদ্রাসায় প্রভাব ফেললে আমরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারবনা।
রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাসেম আজাদ ও কে বি এম আব্দুল মান্নান বলেন, ভাঙ্গা ঢোল আর কত বাজবে! এসব নিয়ে লেখালেখী করে কোন লাভ হবেনা।
রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রাক্তন জুনিয়র শিক্ষক তোজাম্মেল হোসেন এ সংবাদটি প্রকাশ না করার জন্য অসত প্রস্তাব দেন।
তাড়াশ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পড়ালেখায় ব্যাঘাত করা কাম্য নয়। প্রয়োজনে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফকির জাকির হোসেন বলেন, রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. আবুল কাশেম আজাদ ও কে বি এম আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিবেদন দিয়েছি। আশা করছি আদালতের মাধ্যমে তাদের যথাযথ বিচার হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফীউল্লাহ বলেন, এতসব ঘটনার কিছুই জানিনা। বিস্তারিত জেনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিবেন।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবাউল করিম সময়ের সংবাদকে বলেন, রোকনপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার দিকে বিশেষ নজর রাখা হবে। যাতে কেউ শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে।