গোলাম মোস্তফা, নিজস্ব প্রতিবেদক, সময়ের সংবাদ:
চারিদিকে শুধুই কান্নার রোল। মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবার চোখে পানি। কেউ কাঁদছেন নীরবে আর কেউ চিৎকার করে। কেঁদ কেঁদে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন দুই বোন জিয়াসমিন ও পপি। এমন করুণ দৃশ্য দেখে শুভাকাক্সক্ষী ও এলাকাবাসীর চোখেও ঝরছে পানি। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বিলাপ করছে আর বলছে, কি দোষ ছিল মেধাবী প্রাণবন্ত রুপার? স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে বড় উকিল হবে। সেই স্বপ্ন পুরণের আগেই পৃথিবী থেকে কেন নির্মমভাবে শেষ করে দেওয়া হলো তাকে।
টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে গণ ধর্ষণের পর পৈশাচিকভাবে খুনের শিকার জাকিয়া সুলতানা রুপার লাশ বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটার দিকে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্থান থেকে তোলার পর ছয়টার দিকে তার নিজ গ্রাম সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়িতে পৌছায়। লাশ বাড়িতে আসার পর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। এ খবর আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজারো মানুষ একনজর দেখার জন্য নিহতের বাড়িতে ভিড় জমায়। লাশের কফিন জড়িয়ে কান্না শুরু করে স্বজনরা। আদরের বোনের কফিনে বার বার চুমো খেতে থাকে জেসমিন ও রুপা।
এলাকার লোকজন বিক্ষোভে ফেটে পড়নে। তাদের মুখে ছিল একটাই স্লোগান। রুপা হত্যাকারীদের অবিলম্বে ফাঁসি চাই……..। লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে আসেন বড় ভাই হাফিজুর রহমান এবং আরো কয়েকজন নিকট আত্মীয়।
এ সময় রুপার লাশের পাশে বিলাপ করতে থাকা রুপার বড় ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, আমি কিশোর কাল থেকে নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি দিনমজুর খেটে রুপার পড়ালেখার খরচ যোগায়েছি। সেই আদরের ছোট্র বোনটি আমার অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। স্বপ্ন ছিল বড় উকিল হবে। ঢাকা আইডিয়াল ল কলেজ থেকে এ বছরই তার ওকালতি পড়াও সম্পন্ন হয়ে যেত। অথচ এক নৃশংস হত্যায় লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হলো তাকে। হাফিজুর কেঁদে কেঁদে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, আমার বোনের ধর্ষণ ও খুনের সঙ্গে জড়িত ৫ জনের বিচার দ্রুত বিচার আইনে করা হোক। নরপশু খুনিদের জন্য এমন এক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক যাতে আর কোনো ভাইয়ের আদরের বোনকে এভাবে দুনিয়া ছেড়ে যেতে না হয়।
বড় বোন জিয়াসমিন খাতুন বলেন, গত ঈদ স্বামীর বাড়িতে করেছি। এই ঈদে কথা ছিল সবাই এক সঙ্গে বাবার বাড়িতে ঈদ করবো। আদরের রুপা বোন আমার সেই কথা রাখেনি। ঈদের ঠিক দু’দিন আগে বাড়ি এসেছে ঠিকই। তবে প্রাণহীন দেহ নিয়ে। এখন আমার মা আর ছোট ভাই-বোনকে দেখার মতো কেউ রইলো না। এভাবে বলতে বলতে বার বার মুর্ছা যাচ্ছিল সে।
রুপার ছোট বোন পপি বলেন, আমরা দুইবোন ছিলাম জোড়া কবুতরের মতো। ডানা মেলে উড়তে পারতামনা ঠিকই। তবে মনের আকাশে একসঙ্গে পাখা মেলে ঘুরতাম। পড়ালেখা ও প্রয়োজনে মাঝে-মধ্যে দু’জনকে আলাদা থাকতে হতো। তারপরও একটু সুযোগ হলে আপু আমার কম জীবিকারর্ স্থল শেরপুরে ছুটে আসতেন। কখনওবা আমিই যেতাম তার কর্মস্থল জামালপুরে। পরিবারের সীমাহীন দৈন্যতা থাকার পরও দু’বোনে মিলে আনন্দ আর হই হুল্লুরে থাকতাম। কখনো আদর করে আপু আমাকে খাইয়ে দিত আবার কখনওবা আমি আপুকে খাইয়ে দিতাম। অথচ ভাবতে অবাক লাগছে এখন সেগুলো শুধুই স্মৃতি। একদল হায়নার ছোবলে অকালে ঝরে গেছে আপুর প্রাণ। এ সময় তিনি বিলাপ করে বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর আপুই আমাদের সবকিছু দেখভাল করতো। এখন আপু নেই, আমরা কি নিয়ে বাঁচব?
পাঁচ বছর বয়সী রুপার ভাতিজি হুমায়রা খাতুন হিমু বলে, ফুফি এবারের ঈদে অমার জন্য নতুন জামা কিনে রেখেছিল। বলেছিল ঈদে বাড়ি আসার সময় নিয়ে আসবে। সঙ্গে খেলনা আর অনেক চকলেট আনার কথাও বলেছিল। সবাই কেঁদে বলছে আমার ফুফিকে হত্যা করা হয়েছে। তাহলে আমাকে কে ঈদে নতুন জামা আর চকলেট কিনে দেবে? এ সময় ছোট্র শিশুটিও দাবি জানায়, তার ফুফিকে যারা মেরেছে তাদের যেন ফাঁসি দেওয়া হয়।
মেয়ের জন্য কেঁদে অসুস্থ মা হাছনা হেনা বানু হাসপাতালের বেড থেকে কলিজার টুকরা, নাড়ী ছেড়া বুকের ধনকে শেষবারের মতো একবার দেখতে ছুটে এসেছেন বাড়িতে। মুর্ছা যাচ্ছেন আর বার বার ছুটে যাচ্ছেন গলে পঁচে যাওয়া আদরের মেয়ের মরদেহের কাছে। দূর্বল আর ক্লান্ত শরীরে তিনি কেঁদে কেঁদে বিলাপ করতে থাকেন। বলেন, স্কুল বয়সে অন্যের জমির ইরি-বোরো ধানের চারা তুলেও নিজের পড়ালেখার খরচ যোগাতো আমার সোনা মেয়েটি। স্বপ্ন দেখতো উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একদিন বড় অফিসার হবে। বিয়ের কথা তুললে বলতো, মা আমি আরও পড়ে বিয়ে নিয়ে ভাবতে চাই। আগে চাকরি করে আমার ছোট ভাই-বোনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া আমি চলে গেলে তোমাকেই বা কে দেখবে। তার কোন আশাই আর পূরুণ হলো না। ঠিকই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল মেয়েটি। এখন একটাই দাবি আমার মেয়ের খুনিদের ফাঁসি দেখে আমি যেন কবরে যেতে পারি।
সহপাঠি আর গ্রামবাসী জানান, রুপা খুবই ভালো মেয়ে ছিল। মাত্র ৩ শতক বসতঘরের জায়গা ছাড়া সম্পদ বলতে আর কিছুই নেই তাদের। দিনমজুর খেটে তার বড় ভাই হাফিজুর রহমান রুপাকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। সে কারো সঙ্গে কখনো উচ্চ বাক্যে কথা বলতেন না। এ যুগের মেয়ে হয়েও চলাফেরায় সর্বদা শালীনতা বজায় রেখে চলতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। তাহাজ্জুদ নামাজও আদায় করতেন। অথচ এমন একজন সৎ, মেধাবী প্রাণবন্ত মেয়েকে এভাবে অকালে জীবন দিতে হলো। এ সময তারা মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে জোড় দাবি জানান দোসীদের যেন দ্রুত ফাঁসি দেওয়া হয়। পাশাপাশি রুপার শিক্ষিত ছোট ভাই-বোনের জন্য যেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন তিনি।
রুপার লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হলে কান্না আর আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। বাদ মাগরিব জানাযা শেষে তার লাশ আসান বাড়ি কবস্থানে দাফন করা হয়। জানাযায় অংশ নেন তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম ফেরদৌস ইসলামসহ বহু মানুষ। রুপা (২৭) সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামের মৃত জেলহকের মেয়ে।
প্রসঙ্গত: গত শুক্রবার বিকেলে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহগামী নিরাপদ পরিবহনের ‘ছোয়া’ নামের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৩৯৬৩) একটি বাসে ওঠেন রুপা। ময়মনসিংহে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে পরদিন শেরপুর শহরের কর্মস্থলে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রুপা আর গন্তব্যে পৌছানো হয়নি। ওই বাসের ভেতর চালক, সুপারভাইজার এবং তিন হেলপার তাকে একে একে ধর্ষণের পর পৈশাচিক কায়দায় খুন করে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে রক্তাক্ত লাশ। পরিচয় না মেলায় গত শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারীশ লাশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করে মধুপুর থানা পুলিশ। এরপর গত সোমবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে নিহতের বড় ভাই লাশ সনাক্ত করেন। তার দেওয়া তথ্য মতে সেই রাতেই মধুপর থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় পাঁচ ঘাতক। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তারা ‘ চলন্ত বাসে গণ ধর্ষণের পর পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয় মেধাবী প্রাণবন্ত রুপাকে’।