গোলাম মোস্তফা, নিজস্ব প্রতিবেদক, সময়ের সংবাদ:
সকালের লাল সূর্য উদয় হয়েছে। ফজরের নামাজ শেষে ঈদের আনন্দে মসজিদে গজল হওয়ার কথা। গ্রামের ব্রিজের রেলিং-এ দু’পাশে বসে ঈদের নামাজের আগে কিছু সময় যুবাদের আড্ডা। পাড়ার উঠানে শিশু-কিশোরদের হই হুল্লোর আর আতসবাজি ও পটকা ফুটানো। দলবেধে ঘুরে ঘুরে এ বাড়ি-ও বাড়ি কোরবানির গরু, খাসি দেখা। সাউন্ড বক্সে উচ্চৈঃ শব্দে ঈদের গান বাজানো। এবারের ঈদে এ সবের কিছুই ছিলনা আসানবাড়ি গ্রামে। চারি দিকে শুধুই সুনসান নীরবতা। রুপার নির্মম মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ পুরো গ্রাম।
গ্রামে ঈদের নামাজের সময় বেধে দেওয়া হয় সকাল ৮টায়। সকাল সারে ৭ টায় রুপাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়। ফজরের নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসেই আছেন মা হাছনাহেনা বানু। আদরের প্রাণবন্ত মেয়েকে হারিয়ে চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে তার। হু হু করে কাঁদছেন আর প্রাণভরে দোয়া করছেন মেয়ের জন্য “আল্লাহ আমার কলিজার টুকরাকে তুমি কবরে সুখে রেখো-শান্তিতে রেখো। আর অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করো….”।
নামাজ আদায় করে মায়ের পাশেই চৌকিতে শুয়ে আছেন রুপার ছোট বোন পপি। কেঁদে কেঁদে দু’চোখের পাতা ফুলে গেছে। তুবুও কাঁদতেই আছে। তিনি বলেন, চাকরি পাওয়ার পর থেকে কোরবানির ঈদে আমরা রুপা বোনের টাকা পাঠানোর অপেক্ষায় থাকতাম। সে টাকা পাঠালে বাড়িতে কোরবানি হতো। যেদিন তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার আগের দিনও বলেছিল “ আর এক-দু’দিন অপেক্ষা কর, আমি কোরবানির টাকা পাঠিয়ে দেব।” রুপা টাকা দিতে না পারলে সে বছর বাড়িতে কোরবানি হতো না। তারপরও কতো আনন্দ ছিল আমাদের পরিবারে। অনেক দিন পর আপু ঈদে বাড়ি আসতেন। ঈদের দিন বাড়ির আঙিনা ছেড়ে কোথাও যেতাম না। সারাদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতাম। চান রাতে আমি রুপার হাত মেহেদি রঙে সাজিয়ে দিতাম আর ও আমার হাত সাজিয়ে দিতো। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোনেরা মিলে লাচ্চা, পায়েস আর লুচি, পরোটা বানাতাম। ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে পরিবারের সবাই এক সঙ্গে খেতাম। রান্না বান্না শেষে করে আমি ওর চুল বেধে দিতাম আর ও আমার চুল বেধে দিতো। আর আজ এ পর্যন্ত বাড়িতে কোন রান্নার চুলাই জ্বলেনি।
তিনি আরো বলেন, ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বরে বাবা মারা গেছে। বোনটিকেও মেরে ফেলা হলো। এখন সরকারের কাছে একটাই দাবি, অপরাধীদের যেন দ্রুত ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় তিনি বগুড়াস্থ এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে তার জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করায় এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি দেশবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন রুপা হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে ফুসে ওঠার জন্য।
আরেক ঘরে শুয়ে আছেন বড় ভাই হাফিজুর রহমান। বলেন, আমি কিশোর কাল থেকে নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি দিনমজুর খেটে রুপার পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছি। সেই আদরের ছোট্র বোনটি আমার অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছিল। স্বপ্ন ছিল বড় উকিল হবে। ঢাকা আইডিয়াল ল কলেজ থেকে এ বছরই তার ওকালতি পড়াও শেষ হয়ে যেতো। অথচ নির্মমভাবে খুন করা হলো তাকে। রুপাকে হারিয়ে কেঁদে কেঁদে আর না খেয়ে পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। গতকাল (শুক্রবার) সন্ধায় বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে এসে সবার চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। কেঁদে কেঁদে বুকে ব্যাথা। অনেক আদরের ছোট বনের অকাল মৃত্যুতে কষ্টে বুক ফেটে যায়।
বড় বোন জেসমিন খাতুন বলেন, পরিবারের অন্যতম উপর্জনক্ষম বোনের এমন নির্মম মৃত্যুতে আমরা দিশেহারা। বোনের দাফনের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে পরিবারের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তিনি আরো বলেন, বোন আমার খেয়ে না খেয়ে পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল। যেদিন তাকে মেরে ফেলা হয় সেদিনও বগুড়াতে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে টাকার অভাবে দুপুরের খাবার না খেয়ে শুধু পানি খেয়ে কর্মস্থলে ফিরছিল। বলেছিল কষ্ট করে লেখাপড়া শিখছি। ঠিকই একদিন উকিল, ব্যারিষ্টার হয়ে চার চাকার গাড়ি চরে তোর বাড়িতে যাবো।
ছোট ভাই উজ্জল হোসেন বলেন, ঈদে মাঠে যেতে মন চাইছিলো না। তার পরও বোনের জন্য দোয়া করতে দু’ভাই ঈদের নামাজে শরীক হয়েছি। রুপা বোনের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ঈদের নামাজের মোনাজাতে বিশেষ দোয়া করা হয়েছে। নামাজ শেষে দুই ভাই মিলে বোনের কবর জিয়ারত করেছি।
রুপার বড় ভাবী সম্পা খাতুন বলেন, রুপার মৃত্যুর পর থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত (৭ দিন) আমাদের বাড়িতে কোন চুলা জ্বলেনি। পাড়ার লোকজনই রান্না করা খাবার আমাদের বাড়িতে দিয়ে গেছে। তাদের অনেকে পাশে বসে খাইয়েছে। তিনি এও বলেন, আমার শিশু সন্তান হুমায়রা খাতুনের স্কুলের বেতন, বই, খাতা, স্কুলব্যাগ সবকিছু আমার ওই ননদ কিনে দিত। বলেছিল, এবারে ক্লাস ওয়ানের পরীক্ষায় প্রথম হতে পারলে একটি লাল ছাইকেল কিনে দেবে।
পড়শি আর স্বজনরা জানান, রুপা হত্যার কারণে গ্রামে কোন ঈদের আনন্দ নেই। এবারে সবাই পুরান কাপর পরিধান করে ঈদ মাঠে গেছে। বাড়ি বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার তাদের বাড়িতে দেওয়া হচ্ছে। তবে কেউ খেতে চাইছিলো না। অনেক পিড়াপিড়ি করে সবাইকে অল্প একটু করে খাওয়ানো হয়েছে। রুপাকে হারিয়ে আমরা হারিয়েছি আমাদের সন্তান, আমাদের বোনকে। সেই সঙ্গে হারিয়েছি আসানবাড়ি গ্রামের গর্ব।
রুপার পরিবারে একমাত্র ছোট্র শিশু হুমায়রা খাতুনকে (৫) মন খারাপ করে ঘুরে ঘুরে একবার বাবার কাছে একবার মায়ের কাছে যেতে দেখা যায়। বলে, সবাই মন খারাপ করে শুয়ে বসে আছে আর কাঁদছে। ফুপিকে মেরে ফেলেছে তাই আমাদের বাড়িতে ঈদের আনন্দ নেই।
রুপার বোনের চাকরির ব্যবস্থা করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর হত্যার শিকার জাকিয়া সুলতানা রুপার বোনের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিম। গত শুক্রবার রুপার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়িতে এক স্বরণ ও শোক সভার আয়োজন করেন ওই গ্রামবাসী। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দীকা। এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে তিনি বগুড়াস্থ এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে রুপার বোন পপির যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তাড়াশ উপজেলা পরিষদের অনুদান ১০ হাজার টাকা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২৫ হাজার টাকা, এমপি মিলন ব্যক্তিগতভাবে ৫০ হাজার টাকা এবং মন্ত্রী নাসিম ১ লাখ টাকার চেক নিহত রুপার মা হাছনাহেনা বানুর হাতে তুলে দেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অপরাধীদের দেশের আইনানুযায়ী এমন বিচার করা হবে, যেন এই দেশে আর কোন মেয়ের প্রাণ অকালে ঝরে না যায়। আসামিদের পক্ষে কোন উকিলকে না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া গ্রেফতারকৃত আসামিদের দ্রুত বিচার আইনে চরম শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য আইনমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য গাজী ম ম আমজাদ হোসেন মিলন সরকারের পুলিশ বাহিনী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, পুলিশ-সাংবাদিক ন্যায়ের পক্ষে তৎপর আছে বিধায় রুপা হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মাদ হান্নান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. আব্দুল হক, সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিত কর্মকার, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুর ইসলাম লাবু, পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দীন আহাম্মেদ প্রমুখ।
বিচার ও পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানবন্ধন
মেধাবী জাকিয়া সুলতানা রুপার ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিতে এক মানববন্ধন কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদের পরের দিন গত রবিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ প্রেস ক্লাবের সামনে ঢাকাস্থ তাড়াশ সমিতি এর আয়োজন করে। এতে ঢাকাস্থ তাড়াশ সমিতির সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন।
প্রায় আড়াই ঘন্টা ব্যাপী ওই মানবন্ধনে বক্তারা দ্রুত বিচার আইনে রুপা হত্যার বিচার দাবি করেন। সেই সঙ্গে দরিদ্র রুপার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও ছোঁয়া পরিবহনের মালিককে গ্রেফতারের দাবিও তোলেন তারা। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে স্বতস্ফূর্তভাবে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তৃতা করেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল হক, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সরদার মো. আফসার আলী, ঢাকাস্থ তাড়াশ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিম হায়দার, মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান সাজু প্রমুখ।
প্রসঙ্গত:
গত শুক্রবার, ২৫ আগষ্ট বিকেলে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহগামী নিরাপদ পরিবহনের ‘ছোয়া’ নামের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৩৯৬৩) একটি বাসে ওঠেন রুপা। ময়মনসিংহে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে পরদিন শেরপুর শহরের কর্মস্থলে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রুপা আর গন্তব্যে পৌছানো হয়নি। ওই বাসের ভেতর চালক, সুপারভাইজার এবং তিন হেলপার তাকে একে একে ধর্ষণের পর পৈশাচিক কায়দায় খুন করে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে রক্তাক্ত লাশ। পরিচয় না মেলায় গত শনিবার, ২৬ আগষ্ট ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারীশ লাশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করে মধুপুর থানা পুলিশ। এরপর গত সোমবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে নিহতের বড় ভাই লাশ সনাক্ত করেন। তার দেওয়া তথ্য মতে সেই রাতেই মধুপর থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় পাঁচ ঘাতক। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তারা ‘ চলন্ত বাসে গণ ধর্ষণের পর পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয় মেধাবী প্রাণবন্ত রুপাকে (২৭)। সে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামের মৃত জেলহক প্রামানিকের মেয়ে।